-বাচ্চারা কথা বলোনা। এক বাবা ছেলের গল্প বলি; মন দিয়ে শুনো। ছেলেকে তার বাবা খোকা বলে ডাকতো। খোকা দেশের বাইরে থাকতো আর বাবা তার ছেলের বউ এবং নাতীদের সাথে দেশে।
রফিক নিয়াজ ড্রয়িং রুমে তার পরের দুই প্রজন্মকে গল্পটা শুনাচ্ছিলেন। সপ্তাহে কয়েকবার পরিবারের ছোট বড় সবাইকে নিয়ে তিনি এই রকম আড্ডার আসর বসান। কখনো কখনো সেটা সিরিয়াস হয়ে যায়। তখন তা পারিবারিক পাঠশালায় রুপ নেয়।
“বাবার নাম আহমেদ সুরুজ”; রফিক নিয়াজ আবার গল্পটা শুরু করলেন;
-কিছু কথা বাচ্চারা তোমাদের জন্য কঠিন লাগবে। তবুও শুনো। মানুষে মানুষে চিন্তার ভিন্নতা থাকে । কিন্তু নৈতিক কিছু বিষয় আছে যা মূল্যদিয়ে বোধের ভিতর রাখতে হয়; যাকে সবাই মূল্যবোধ বলে ! সেখানে সম্ভবত খুব বেশি ভিন্নতা থাকতে নেই ! আহমেদ সুরুজ সব সময় সেই মূল্যবোধগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছেন এবং আদরের খোকাকেও তা আজীবন বলে এসেছেন ! গল্পটার মোরাল আসলে মূল্যবোধ এবং কাল-পাত্রভেদে এর উপলদ্ধি নিয়ে !
কথাগুলি বলে রফিক নিয়াজ একটু দম নিলেন। ইতোমধ্যে ফজলের মা চা নিয়ে এসেছে। এক কাপ হাতে নিয়ে তিনি আবার গল্প শুরু করলেন।
-নিজ ঘরের লোকদের মুখোশের আড়ালে অশোভন আচরণ সুরুজকে বিষন্ন করতো ! ঘর মানে ছেলের এবং নাতিদের নিয়ে সংসার। তার মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক অশোভন আচরণ নিয়ে তিনি তেমন উচ্চবাচ্য করেননি ! কিন্তু তার এই বিষন্ন অভিব্যাক্তিতে ছেলের বউ খুব অসন্তুষ্ট হলো ! অতঃপর সুরুজ ঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন !
পরদিন খোকার ফোন এলো ।
-বাপু, তুমি ঘর ছেড়ে চলে গেছো?
-হ্যাঁ রে, একটু একা থাকি
-তুমি ঘর ছেড়েছো তাতে কার কী ? তোমার নিজেরই কষ্ট !
খোকার এমন অনাকাঙ্খিত কথার কোন জবাব তিনি দিলেন না ! খোকা ফোন রেখে দিলো ! খোকার অজ্ঞতাকে তুচ্ছ করে তিনি মৃদু হাসলেন !
কথা শেষ করে সুরুজ বৃদ্ধাশ্রমে তার বিছানায় ফিরে গেলেন ! অ্যালবাম খুলে খোকার সাথে তার ছবি গুলোতে হাত বুলিয়ে দিলেন ! অ্যালবামটা তার কাছে শুধু দুজন মানুষের ছবির নয়; দুজনের একটা বিশাল জগৎ যেনো !
সুরুজ মাঝে মাঝে ডায়েরি লিখেন ! চশমটা চোখে নিলেন ! ওতে তেমন পরিষ্কার দেখেননা ! প্লাস ১.৫; বেশ লম্বা সময় হলো বদলানো হয়নি ! ডায়েরিতে তিনি কিছু লিখলেন !
-ওটা শুধু পুরুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম ছিল? রফিকের ছোট ছেলের বউ জানতে চাইলো
-না, মহিলাদের জন্যও। মহিলাদের অংশটা বি-ব্লকে। এ এবং বি ব্লকের মাঝখানে বাগান। মূলত ফুলের বাগান; তবে কিছু সবজিরও। সুরুজ বিশেষ করে বিকেল বেলায় ওখানে যেতো। ফুল গাছের যত্ন করতো; এতে তার ভালোই সময় কেটে যেতো। মাঝে মধ্যে অবশ্য খোকার কথা মনে করে তার মন ভার হতো।
-পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে বিশেষ কোন রেস্ট্রিকশন ছিল? ছোট ছেলের বউ ফলোআপ প্রশ্ন করলো
-প্রায় সব মহিলার সাথেই সুরুজ কমবেশি কথা বলতো। তাদের একজন মনোরমা নাভিদ। তিনি মিতভাষী এবং প্লিজেন্ট পারসোনালিটির অধিকারী। তাঁকে দেখলেই সুরুজের জানতে ইচ্ছে করতো, তিনি দিলারা জামানের বোন কিনা? অদ্ভুত মিল; বয়স সত্তুর প্লাস। কিন্তু কেন জানি জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে দুজন দুজন সম্পর্কে বেশ কিছু কথা জেনে গেছে। খোকা তার বাপের খোঁজ নিতে ভুলে গিয়েছিল বটে। তবে সুরুজ বিকেলে বাগানে গেলেই মনোরমা বের হয়ে আসতো। রাতে ঘুম হয়েছে কিনা, সকালে ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেন এবং একটা ছোট কাগজে বড় করে “রাতের ওষুধ খাবার সময়ঃ সাড়ে ৯টা” লিখে দিতেন। যাতে ওষুধ খেতে ভুলে না জান।
-তারপর? দু’তিন জন একসাথে প্রশ্ন করলো
-তারপর বিশেষ কিছু নেই। একদিন হঠাৎ করে আহমেদ সুরুজ মারা গেলেন । সবাইকে খবর দেয়া হলো । স্বজন-বন্ধুরা এলো ! খোকা আসতে পারেনি ! পুরনো চশমা এবং ডায়েরিটা সুরুজের ঘনিষ্ট এক বন্ধু বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষ থেকে গ্রহণ করলেন !
-চশমা এবং ডায়েরিটা সুরুজের বন্ধু কেন গ্রহণ করলেন? ছোট ছেলের বউ জানতে চাইল
.-উত্তরটা আমার জানা নেই।কেবল ধারণা করতে পারি।
-তারপর? সুরুজের ছোট ছেলে প্রশ্ন করল
-প্রায় দেড় দশক পরের ঘটনা ! খোকা দেশে ফিরে এসেছে । এখন সেও তেমন ভালো নেই ! বয়স হয়েছে ! ঘরে শান্তি নেই ! সে এখন না ঘরের; না পরের ! বাপুর কথা তার খুব মনে পড়ে ! খোকা একদিন একটা ফোন কল পেয়ে বাপুর সেই ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছে গেলো ! তিনি ডায়েরি এবং চশমাটা খোকার কাছে হস্তান্তর করলেন ! ঘরে এসে খোকা ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলো ! তুমি তুই মেশানো শেষ নোটটায় লেখা আছে, “বুকের ধন আজ তোর ফোন পেলাম ! বললে, তুমি ঘর ছেড়েছো তাতে কার কী, তোমার নিজেরই কষ্ট “! নারে খোকা ঘর ছাড়তে আমার কোন কষ্ট হয়নি ! এটাকে আমার প্রতি তোর তাচ্ছিল্য না বলে তোর বোধের ঘাটতি বলতে চাই । যেদিন জন্ম নিয়েছি সেদিনই তো দুনিয়া ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি ! ঘরতো দুনিয়ার তুলনায় অতি ছোট্ট একটা জায়গা! তবে যা ছেড়ে এসেছি তা উপলদ্ধি করার তোমার ক্ষমতা তোমারই ঘরের মানুষের হাতে বন্দি হয়ে আছে।
ডায়েরি পড়া শেষ করে খোকা অ্যালবামের পাতা উল্টাতে লাগলো ! বাপুর সাথে ঘটনাবহুল ছবিগুলো আগে কখনো দেখেছে কিনা খোকা মনে করতে পারলোনা ! প্রতিটা পাতায় তার চোখের জল টপটপ করে পড়লো! বাপুর চশমাটা খোকা চোখে নিলো ! পাওয়ার মিলছেনা । তবু সে কিছুক্ষণ রাখলো! চশমাটা দিয়ে সে অশোভন স্বভাবের অশ্লীল মনুষগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেলো ! আর সেই বিশাল জগৎটা যা তার বাপু তার জন্য নিজের জীবন বেচে কিনে দিয়েছিলেন !
কিছুক্ষণ থেমে রফিক নিয়াজ জলের গ্লাস হাতে নিলেন। কয়েক ঢোক গিলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, “জগৎটা হারিয়ে সেদিন বাপু কেঁদেছিলো; আজ খোকা নিজে” !
loading...
loading...
সত্য বলতে লেখাটি পড়ে চোখ অশ্রু সিক্ত হলো মিড দা।
loading...
আপনার মন্তব্য কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিলাম; খুব খুশি হলাম !
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
এক্বই বিষন্নতা আজ খোকাকেও গ্রাস করবে। আমাদের জগত আমরাই সংকীর্ণ করে তুলছি। ঘরের মধ্যে ঘর তুলছি।
loading...
আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি কবি !
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
বরাবরই যে কোন লিখা উপস্থাপনে আপনার অসাধারণ নৈপুণ্য লক্ষ্য করি। মুগ্ধ।
loading...
মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি মিঃ মুরুব্বী !
অশেষ ধন্যবাদ !
loading...
বৃদ্ধাশ্রম ও বৃদ্ধদের নিয়ে পড়া আমার গল্প বা কাহিনীগুলো আপনারটা একটু না, অনেকটাই আলাদা।
অন্যসব গল্পে দেখানো হয়, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে একজন পিতা যে মানসিক কষ্টে ভোগেন সেটা। তার শেষ পরিণতি কী কী হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করেন।
আপনি আপনার এই লেখায় সেই বিষয়ে দ্রুত একটু আলোকপাত করে আপনার গল্পের মূল জায়গায় ফিরে গিয়েছেন। অর্থাৎ উপলব্ধি'টা কোথায় সেটা দেখিয়েছেন।
বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে পিতার যে অনুভূতি হয়েছিল কিংবা সেদিন টেলিফোন পেয়ে ছেলের যে অজ্ঞতার কথা পিতা মনে করে মুচকি হেসেছিলেন সেটা যদিওবা ছেলে বুঝতে পারলো তবে সেটা সেই নিজের বৃদ্ধবয়সে এসেই, তার আগে নয়।
আসলে এই উপলব্ধিটা আরও আগে হওয়া উচিত।
ভালো লাগলো আপনার ছোট গল্পঃ উপলব্ধি।
শুভেচ্ছা মিঃ মিড ডে ডেজারট
loading...
কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ! যদিও আমার পক্ষে গেছে; মুগ্ধতা রাখলাম!
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা !
loading...
আপনার লেখা পড়ে হৃদয় কেঁপে উঠল । যাদের মা-বাবা বৃদ্ধাশ্রমে আছে, তাদের কেমন লাগবে জানি না। তবে আমি রীতিমত কেঁদেছি।
loading...
"আপনার লেখা পড়ে হৃদয় কেঁপে উঠল ……আমি রীতিমত কেঁদেছি।"
আমি যাইই লিখিনা কেন এই মন্তব্যটা থেকে আমি আমার লেখার নিযুত কোটি মূল্য পেলাম!
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা !
loading...
* আপনার শৈল্পিক উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করে। একজন সত্যিকার লেখকের যে নির্লিপ্ততা আপনার মাঝে যেন দেখতে পাই।
শুভ কামনা সবসময়।
loading...
এমন কমপ্লিমেন্ট কার না ভাললাগে !? ভীষণ ভালোলাগা এবং কৃতজ্ঞতা জানালাম কবি!
loading...
গল্পটির বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গী এবং উপস্থাপনা একেবারেই আলাদা স্বীকার করতেই হয়। অবশ্য লেখকের সব লেখাতেই গভীর নৈপূন্যতার পরিচয় মিলে ।
বৃদ্ধ পিতামাতার অসহায়ত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে লেখক হতভাগা সন্তানদের নির্লজ্জ অবহেলার পরিণাম খুব যত্ন করে তুলে ধরেছেন। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর এবং জীবনমুখী একটি পোস্টের জন্য ।
loading...
মন্তব্যে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। মন্তব্যের সাথে ফ্রি কমপ্লিমেন্টও; সবকিছুই পকেটে ভরে নিলাম!
loading...